চার্লস ডিকেন্স-এর অর্থনীতি
[Economics of Charles Dickens]- ২
- প্রফেসর মনতোষ চক্রবর্তী
হার্ড টাইমস এর অর্থনীতি (Economics of Hard Times )
শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে চার্লস ডিকেন্স এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবনা (Economic and social thinking of Charles Dickens in the context of industrial revolution)
হার্ড টাইমস ও অর্থনীতি (Hard Times and Economics )
চার্লস ডিকেন্স এর দশম উপন্যাস হলো হার্ড টাইমস (১৮৫৪)। তৎকালীন ইংল্যান্ড এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ উপন্যাস । ডিকেন্স তাঁর বেশির ভাগ উপন্যাস লন্ডনের পটভূমিতে রচনা করলেও এ উপন্যাসটি ম্যানচেস্টারের আবহে কল্পিত নগরী ভিক্টোরিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ‘কোকটউন’ কে ঘিরে পরিচালিত। উপন্যাসটি একটি শাস্ত্রীয় ত্রিপক্ষীয় কাঠামো অনুসরণ করেছে, যেখানে বিখ্যাত একটি বচন অনুসৃত হয়েছে- "একজন মানুষ যা বপন করে, সে অনুযায়ী সে তার ফসলও কাটে।" ["For whatsoever a man soweth, that shall he also reap."] বইটির ৩টি অংশ/পর্যায় আছে , তাদের শিরোনামগুলো যথাক্রমে -প্রথম: বুনন / বপন" (sow ) দ্বিতীয়: ছেদন/ কর্তন(reap ) , এবং তৃতীয়: সংরক্ষণ/ ভান্ডারজাতকরণ (garner )।
১ :বুনন / বপন (Sowing )
সুপারিনটেনডেন্ট মিঃ গ্রেডগ্রিন্ড কোকটাউনে তাঁর বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে এসে বলেন, " আমি যা চাই তা হল ফ্যাক্টস”। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তিনি বলেন “ ছেলে-মেয়েদের ফ্যাক্টস(ঘটন/ বাস্তবতা) ছাড়া কিছুই শেখাবেন না"। এক ছাত্রী সিসিলিয়া (ডাক নাম তার সিসি), যার বাবা একটি সার্কাসে কাজ করে। সিসিকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন , ‘ঘোড়ার সংজ্ঞা দাও’। যেহেতু তার বাবা সার্কাসে ঘোড়া নিয়ে কাজ করে,তাই গ্রেডগ্রিন্ড তার কাছ থেকে ঘোড়ার সংজ্ঞা দাবি করে বসেন । ঘোড়াটিকে সত্যিকার অর্থে সংজ্ঞায়িত করতে না পারার জন্য সিসিকে তিনি ধমক দিলেন । তখন তার সহপাঠী Bitzer অংকন(ড্রয়িং) এর মাধ্যমে একটি প্রাণিবিজ্ঞানভিত্তিক সংজ্ঞা দেয়। সিসিকে তখন শাস্তিস্বরূপ ফুল বা ঘোড়ার ছবিযুক্ত মেঝের গালিচা তৈরির আদেশ দেওয়া হয়।
মিঃ গ্রেডগ্রিন্ডের বড় মেয়ে লুইসা এবং ছেলে টমাস/ টম । মিঃ গ্রেডগ্রিন্ডের তিন ছোট সন্তান এর নাম হলো: অ্যাডাম স্মিথ ( যে নামটি ব্যক্তিতাবাদ বা laissez -faire পলিসির বিখ্যাত তাত্ত্বিক এর নামের সাথে জড়িত), ম্যালথাস (জনসংখ্যা নীতির প্রণেতা টমাস ম্যালথাসের নাম অনুসারে এ নামকরণ করা হয়েছে ) এবং জেন। লুইসা এবং টম, মিঃ স্লেয়ারি পরিচালিত ট্যুরিং সার্কাসটি দেখতে স্কুলে যায়, কিন্তু তাদের বাবা গ্রেডগ্রিন্ড তাদেরকে বাড়িতে থাকারই আদেশ দিয়েছিলেন। যখন তারা সার্কাসে উঁকি মারছিল লুইসা এবং টমকে ধরে ফেলেন গ্রেডগ্রিন্ড ।
জোশিয়াহ বাউন্ডার্বি, একজন "পুরোপুরি অনুভূতিহীন মানুষ", যে গ্রেডগ্রিন্ডের ঘনিষ্ঠ বন্ধু । সমৃদ্ধ উদ্যোগ এবং মূলধনের বলে বাউন্ডার্বি একজন সফল প্রস্তুতকারক এবং মিল মালিক হয়ে ওঠেন। তবে তিনি প্রায়ই তার শৈশবের নানা ঘটনাকে নানা নাটকীয় ভঙ্গীমায় এবং মিথ্যা কাহিনীর আবরণে বর্ণনা করেন, যা তার গৃহকর্মী মিসেস স্পারসিতকে পর্যন্ত আতঙ্কিত করতো।
অথচ সেই গ্রেডগ্রিন্ড ও বাউন্ডার্বির মতো উঁচু শ্রেণীর মানুষরা ‘অন্য বাচ্চাদের উপর খারাপ প্রভাব’ বিচার বিবেচনা ও শাস্তি প্রদানের দায়িত্ব পালন করতো। গ্র্যাডগ্রিন্ড এবং বাউন্ডার্বি সিসিকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। তবে তারা শীঘ্রই আবিষ্কার করলেন যে, তার বাবা সিসিকে ছেড়ে চলে গেছে। এ মুহুর্তে সার্কাসের সদস্যরাও উপস্থিত হয় তাদের পরিচালক মিঃ স্লেয়ারির নেতৃত্বে। তাদের সামনেই মিঃ গ্রেডগ্রিন্ড সিসিকে দুটি পছন্দের একটি বেছে নিতে বলেন : প্রথমটি হলো- সার্কাসে ফিরে আসা এবং তার পড়াশোনা বন্ধ করা, অথবা দ্বিতীয়টি হলো- তার পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া এবং মিসেস গ্রেডগ্রিন্ডের পক্ষে কাজ করা। সিসি তার পিতার সাথে পুনরায় একত্রিত হওয়ার আশা পোষণ করে সার্কাসে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গ্রেডগ্রিন্ডের বাড়িতে টম এবং লুইসা তাদের বাবার পড়াশুনার চাপে বিরক্ত থাকতো এবং সিসিরও হলো একই দশা ।
স্টিফেন ব্ল্যাকপুল ("ওল্ড স্টিফেন" ডাক নাম) নামে এক কাজপাগল মানুষ- গল্পটির আরেক নায়ক। মিল শ্রমিকদের মধ্যে সে "দ্য হ্যান্ডস" নামে পরিচিত। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাচেল। স্টিফেন একদিন বাড়িতে ঢুকেই দেখতে পায় যে, তাঁর মাতাল স্ত্রী তাঁর দিকে তেড়ে আসছে । বাড়িতে স্ত্রীর অবাঞ্ছিত প্রত্যাবর্তনে স্টিফেন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পরে , এবং কীভাবে আইনী প্রক্রিয়ায় তার বিবাহ-সম্পর্ক ইতি টানা যায়, এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য মিঃ বাউন্ডার্বির কাছে যায় । মিঃ বাউন্ডার্বির বেতনভোগী সহচর হলেন মিসেস স্পারসিত। স্টিফেনের চিন্তাটি তিনি প্রথম প্রত্যাখ্যান করেন। বাউন্ডারবিও ব্যাখ্যা করেন যে, বিবাহ বন্ধন ছিন্নকরণ জটিল ও নিষেধাজ্ঞামূলকভাবে ব্যয়বহুল।
মনোকষ্ট নিয়ে স্টিফেন ফিরে আসে , আর বাড়িতে এসে রাচেলকে তার স্ত্রীর প্রতি যত্ন নিতে দেখেন ।
গ্রেডগ্রিন্ড তার মেয়ে লুইসাকে একদিন বলেন যে, তার চেয়ে ৩০ বছর বেশি বয়সী প্রবীণ জোসিয়াহ বাউন্ডার্বী তার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। সেই প্রস্তাবের সমর্থনে তিনি বলেন যে, বয়সের পার্থক্য বিবাহের পথে কোনো অন্তরায় নয়। তার বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করার জন্য গ্রেডগ্রিন্ড পরিসংখ্যান তথ্য / ফ্যাক্টস উদ্ধৃত করেন । কারণ তিনি ফ্যাক্টস এর উপর অতি আস্থাবান ছিলেন।
লুইসা সেই অসম বয়সের বিয়েতে সম্মতি দেয়। বিয়ের পর নবদম্পতি লিয়নস (লিয়ন) এ যাত্রা করে। সেই সাথে গ্রেডগ্রিন্ডও বাউন্ডার্বির কারখানায় শ্রম কীভাবে ব্যবহৃত হয়, তা পর্যবেক্ষণ করতে যেতে আগ্রহী হন । তাতে টম খুব খুশী হয়ে(বাবার শাসনমুক্ত হয়ে একা থাকতে পারার আনন্দে) তাদের বিদায় জানায় ।
২:ছেদন / কর্তন/ উত্তোলন ( Reaping )
কোকটাউনে বাউন্ডার্বির একটি ব্যাংক আছে। সেখানে " পোর্টার" হিসাবে কাজ করে সিসির পুরনো সহপাঠী Bitzer এবং কঠিন স্বভাবের মিসেস স্পারসিতও বিকেলে দায়িত্ব পালন করে । একদিন এক সুবেশী ভদ্রলোক বাউন্ডার্বির বাড়ির দিক নির্দেশনা খুঁজছিলেন। গ্রেডগ্রিন্ড তাকে পরিচয়পত্র দিয়ে লন্ডন থেকে প্রেরণ করেছেন। তিনি হলেন জেমস হার্টহাউসের। তিনি বেশ কয়েকটি পেশায় নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন , কিন্তু সকলেই তার ওপর বিরক্ত, তার স্বভাবের জন্য ।হার্টহাউসের পরিচয় হয় বাউন্ডার্বির সাথে। তিনি তাকে কাজে গ্রহণও করেন। হার্টহাউস বাউন্ডার্বির কথবার্তায় বিরক্ত। কিন্তু অসুখী লুইসা তাকে মুগ্ধ করে। লুইসার ভাই টম, বাউন্ডার্বির অধীনে কাজ করে। বাউন্ডার্বিকে বিয়ে করার জন্য টম লুইসাকে প্ররোচিত করেছিল। আর টমের আচরণ ছিল বেপরোয়া ও স্বার্থপর ।
জনাকীর্ণ ইউনিয়ন সভায় আন্দোলনকারী স্ল্যাকরিজ স্টিফেন, বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলেন ব্ল্যাকপুল এর বিরুদ্ধে। কারণ স্টিফেন ইউনিয়নে যোগ দেবে না বলেছিল। বাউন্ডার্বি তাকে তলব করে। তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, অন্য লোকেরা কী অভিযোগ করছে। যখন স্টিফেন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন কিন্তু বাউন্ডার্বি স্টিফেনকেই অন্যান্য সাধারণ শ্রমিকের পক্ষ অবলম্বনকারী বলে অভিযুক্ত করেন এবং তাকে বরখাস্ত করেন। পরে অবশ্য লুইসা এবং টম, স্টিফেনের সাথে দেখা করে দুঃখ প্রকাশ করে এবং লুইসা তাকে কিছু অর্থ সাহায্য প্রদান করে। একদিন ব্যক্তিগতভাবে টম তাকে তার কাজ শেষে ব্যাঙ্কের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে। সেদিন ব্যাঙ্কে ডাকাতি হয়। আর তার পরের দিনই স্টিফেন শহর ছেড়ে চলে যায়। এতে অপরাধের সন্দেহ তীর স্টিফেন এর দিকে এসে পরে।
এদিকে আবার মিসেস স্পারসিত, জেমস হারথাউস এবং লুইসার মধ্যে অগ্রসর হওয়া সম্পর্কের বিষয়টি লক্ষ্য করে এবং ব্যভিচারী যোগাযোগের জন্য সন্দেহ পোষণ করে। তাদের সংলাপ শুনতে অক্ষম হলেও মিসেস স্পারসিত ধরে নেন যে, তাদের মধ্যে গোপন প্রেমের বিষয়টি এগিয়ে চলছে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থায় হার্টহাউস যখন লুইসার প্রতি তার ভালবাসার কথা প্রকাশ করে, লুইসা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। মিসেস স্পারসিত লুইসাকে স্টেশনে অনুসরণ করতে এসে দেখে যে, লুইসা তার বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে ট্রেনে চড়েছে । লুইসা বাবার বাড়িতে ফিরে এলে চরম সংকটে সে পড়ে। তার বাবার কঠোর শিক্ষার ফলে তার আবেগ প্রকাশ করার দক্ষতাও যে হ্রাস পেয়েছিল, তা লুইসার আচরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়। বাবার জেরায় লুইসা একসময় অজ্ঞান হয়ে তার বাবার পায়ে পড়ে যায়।
৩: সংরক্ষণ / ভান্ডারজাতকরণ (Garnering )
বাউন্ডার্বির লন্ডনস্থ হোটেলে, যেখানে মিসেস স্পারসিত দেখাশুনা করত , সেখান থেকে তাকে আবার কোকটাউনের স্টোন লজে নিয়ে যায়, যেখানে লুইসা বিশ্রাম নিচ্ছিল । গ্রেডগ্রিন্ড বাউন্ডার্বিকে বলেছিলেন যে, লুইসা হার্টহাউসের প্রেম নিবেদনকে প্রতিহত করেছিল। তবে সে একটি সংকটে পড়েছে এবং তা থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য তার সময় প্রয়োজন। বাউন্ডার্বি ছিলেন অত্যন্ত দুরাচারী। মিসেস স্পারসিত তাকে বিভ্রান্ত করেছেন, এ অভিযোগে মিসেস স্পারসিতের প্রতি বাউন্ডার্বি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। গ্রেডগ্রিন্ডের আর্জি উপেক্ষা করে তিনি ঘোষণা করেন যে, পরদিন লুইসা তার কাছে না এলে বিবাহ সম্পর্ক বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সে আর ফিরে যায়নি ।
এদিকে হার্টহাউসও কোকটাউন ছাড়েন। স্ল্যাকব্রিজ যখন স্টিফেন ব্ল্যাকপুলের নাম কালিমালিপ্ত করে তুলছে, তখন রাচেল (স্টিফেনের বন্ধু) ব্যাঙ্কে গিয়ে জানায় যে, স্টিফেন কোথায় আছে সে জানে এবং স্টিফেন অচিরেই কোকটাউনে ফিরেও যাবে। তবে বাউন্ডার্বি রাচেল এর কথায় সন্দিহান হয়ে পড়েন , যখন সে তাকে বলে যে স্টিফেনকে যেদিন বরখাস্ত করা হয়েছিল, লুইসা এবং টম স্টিফেনের সাথে দেখা করেছিল এবং তাকে গ্রেডগ্রিন্ডের বাড়িতেও নিয়ে যায় ।
মিসেস স্পারসিত একদিন এক বৃদ্ধা মিসেস পেগেলারের খোঁজ পেয়েছিলেন, যিনি বাউন্ডার্বির বাড়ি দেখার জন্য রহস্যময়ভাবে ঘুরাফিরা করছিলেন ।বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁকে বাউন্ডার্বির মা হিসাবে জানতে পেরে অবাক হন এবং বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেই মা তাঁর কষ্টের জীবনে বাউন্ডার্বিকে পরিত্যাগ না করে তাকে ভালভাবেই লালনপালন করেছিলেন। আর বাউন্ডার্বি যখন নিজে প্রতিষ্ঠিত , তখন নিজ মায়ের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে , মা কখনও তার সাথে দেখা করতে আসবেন না। বাউন্ডার্বির বিচিত্র ও হীন চরিত্র এখানে ফুটে উঠেছে ।
এক রবিবার বিকালে বেড়ানোর সময়, রাচেল এবং সিসি, স্টিফেনকে খুঁজে পান। স্টিফেন কোকটাউনে ফিরে যাওয়ার সময় একটি পরিত্যক্ত পিটের(খনির) খাদে পড়ে গিয়েছিলেন। তাকে গ্রামবাসীরা উদ্ধার করেছিল। ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনায় নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করে এবং শেষবারের মতো রাচেলের সাথে কথা বলার পরে স্টিফেন মারা যায়। লুইসা এবং সিসি তখন সন্দেহ করে যে, টমই ব্যাঙ্ক ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়েছে। টমই স্টিফেনকে ব্যাঙ্কের বাইরে বেরিয়ে আসতে বলেছিল যাতে তাকে জখম ও দোষী সাব্যস্ত করা যায়।
অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় টম পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সিসি টমকে ইতিমধ্যে সহায়তা করেছিল যাতে সে মিঃ স্লেয়ারির সার্কাসে যোগ দিতে পারে। লুইসা এবং সিসি সেখানে টমকে পরে খুঁজে পেয়েছিল। গ্রেডগ্রিন্ড তোমার অধঃপতন দেখে হতাশ হয়ে পড়েন। তবে সন্তানকে বাঁচানোর জন্য টমকে লিভারপুলের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াসে স্লেয়ারির সহযোগিতায় একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়, যেখান থেকে টম যেন বিদেশে পালাতে পারে। পরিকল্পনাটি অস্থায়ীভাবে হলেও বিট্টিরের আগমন দ্বারা বানচাল হয়ে যায় । টমকে বিচারের সামনে আনার মাধ্যমে বাউন্ডার্বির কাছ থেকে পদোন্নতি লাভের প্রত্যাশা করেছিল বিট্টির। তবে স্লেয়ারি একটি সাহসী ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং টমকে লিভারপুলে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে জাহাজেও উঠিয়ে দেয়।
বাউন্ডার্বি তার মায়ের পরিচয় উন্মোচন করায় এবং তাতে তিনি অসম্মানিত হওয়ায় মিসেস স্পারসিতকে শাস্তি দিয়েছিলেন। অবশ্য পাঁচ বছর পরে, বাউন্ডার্বি রাস্তায় একদিন অজ্ঞান হয়ে মারা যান। ইতোমধ্যে মিঃ গ্রেডগ্রিন্ডও তাঁর আদর্শ হিসাবে উপযোগবাদি ধারণাটি ত্যাগ করেন এবং জীবনের শেষ ভাগে যাবতীয় ঘটনাকে "বিশ্বাস, আশা ও হিতৈষণার অধীন" করার চেষ্টা করেন।
রাচেল তার সৎ শ্রমের জীবন অব্যাহত রাখে। স্টিফেন ব্ল্যাকপুলকে মিঃ গ্রেডগ্রিন্ড অপরাধমুক্ত বলে ঘোষণা করেন । এদিকে অশ্রুসিক্ত চিঠিতে তার অপরাধের কথা স্বীকার করে টম, কোপটাউনের কাছে জ্বরে মারা যায়। ইতোমধ্যে লুইসা নিজেও বৃদ্ধ হয়, পুনরায় বিবাহ সে করেনি এবং তার নিজের সন্তানও ছিলনা। লুইসা কম ভাগ্যবান হলেও সিসির বাচ্চাদের ভালবাসায় সে সিক্ত থাকে । সিসি বাস্তবের মুখোমুখি হয়েও সমস্ত ক্ষেত্রে তার জীবনকে কল্পনা এবং অভিনবত্বে ভরিয়ে তুলতে পেরেছিলো ।
হার্ড টাইমস এর কল্পচিত্র -প্রেক্ষাপট
ডিকেন্স শিল্প শহরের কারখানার কিছু কর্ম পরিবেশ সম্পর্কে পাঠকদের জ্ঞাত করতে ম্যানচেস্টার,এবং Preston র কল্পচিত্র টেনে এনেছেন। তাঁর মূল ভাবনা ছিল, প্রচলিত অর্থ-সামাজিক কাঠামোতে "আমার ক্ষমতায় চরমতম আঘাতটি করতে হবে", আর মনে রাখতে হবে - “সমৃদ্ধি এবং নৈতিকতা সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয়” । তিনি তাঁর নৈতিক দানবদের মিঃ বাউন্ডার্বি এবং জেমস হারথহাউসের চিত্রায়নের মাধ্যমে অবগঠন (ডিকনস্ট্রাক্ট) করেছিলেন। ডিকেন্স কল্পনা শক্তির গুরুত্বের উপর বিশ্বাস করতেন। বস্তুগত ঘটন ও পরিসংখ্যান তথ্যের নিরিখে মানুষের জীবনকে খাটো করে দেখা উচিত নয় বলে তিনি অভিমত রাখেন। সার্কাসের বিবরণ যা তিনি দিয়েছেন তা হলো " জীবনের সামান্য প্লেইন ফ্যাক্ট এর অতি যত্নশীল বর্ণনা” ।
অর্থনৈতিক আদর্শ হিসাবে আক্রান্ত উপযোগিতাবাদ (Utilitarianism)
Jeremy Bentham (1748 - 1832)
ডিকেন্স এর বিদ্রুপের অন্যতম লক্ষ্য ছিল উপযোগবাদীরা । উপযোগিতাবাদ বা উপযোগবাদ ( Utilitarianism ) দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন জেরেমি বেন্থাম ও জেমস মিল (যিনি জন স্টুয়ার্ট মিল এর পিতা)। বেনথামের প্রাক্তন সেক্রেটারি, এডউইন চাডউইক ১৮৩৪ সালের দারিদ্র্য আইন এর রূপরেখা প্রস্তুত করতে সহায়তা করেছিলেন। আর সেই আইন ওয়ার্ক হাউসের জীবনকে অস্বস্তিকর করে তুলেছিল। উপন্যাসটিতে এই মনোভাব, বিট্টারের প্রতি গ্রেডগ্রিন্ড কতৃক সহানুভূতি প্রদর্শনের আবেদন বিষয়ক প্রতিক্রিয়ায় লক্ষ্য করা গিয়েছে।
শিশু শিক্ষার পাশাপাশি পুঁজিবাদে শিল্পকারখানা পরিচালনার রীতিনীতি- এর মধ্যে স্বার্থপরতার দর্শন হিসাবে ডিকেন্স যা দেখেছিলেন, তাতে তিনি হতবাক হয়েছিলেন। সেখানে বস্তুবাদিতা/ বৈষয়িক বিষয়ের সাথে শিল্পচর্চায় তথা শিল্পপরিচালনার রীতিনীতিতে ব্যক্তিবাদিতা (laissez -faire ) সম্মিলিত হয়েছিল । ডিকেন্সের ব্যাখ্যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উপযোগবাদী মূল্যবোধের প্রসার, শ্রমিকদের প্রতি মিল মালিকদের অবজ্ঞা প্রদর্শনকেই উৎসাহ দেয় । উপযোগবাদে তরুণদের কল্পনাশক্তিকে অবহেলা করা হয়েছিল, কারণ সেখানে কল্পনা বা অনুভূতির পরিবর্তে বাস্তবতা/ সত্যের উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া হয়েছিল। চার্লস নাইটকে লেখা একটি চিঠিতে ডিকেনস উগ্র ইউটিলিটিরিয়ানদের "ঘটন এবং গড়, এবং অন্য কিছু নয়" এর মধ্যেই আবদ্ধ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন । তিনি কাজের (কর্মক্ষেত্রের) পরিবেশ সংস্কারের জন্য প্রচারণা চালানোর ইচ্ছা পোষণ করেন। 1839 সালের প্রথম দিকে ডিকেন্স ম্যানচেস্টারে কারখানা পরিদর্শন করেন এবং শ্রমিকরা যেখানে পরিশ্রম করে তার পরিবেশ মর্মান্তিক/ আতংকজনক বলে তার কাছে মনে হয়েছিল।
প্রয়োজনীয় শিক্ষা কার্যক্রম :
জন স্টুয়ার্ট মিলের ওপর তাঁর পিতার যেমন কঠোর শিক্ষা গ্রহণের চাপ ছিল তেমনি হার্ড টাইমস এর লুইসার ওপর গ্রেডগ্রিন্ডের একইরকম চাপ ছিল, যে শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে ছিল বিশ্লেষণাত্মক, যৌক্তিক, গাণিতিক এবং পরিসংখ্যান বিষয়গত কঠোর অনুশীলন । কথিত আছে যে, জন স্টুয়ার্ট মিলের যখন বয়স বিশের কোঠায় , তখন অতিরিক্ত চাপে তার স্নায়ুবিক ভঙ্গুরতা ( নার্ভাস ব্রেকডাউন) ঘটেছিল। অনেকের বিশ্বাস যে, সেই বয়সে তার যতটা আবেগীয় ধারণ ক্ষমতা, তার তুলনায় পড়াশুনায় চাপ ছিল অনেক বেশি। অধিকতর বিশ্লেষণ(analysis ) এবং গণিতে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য তাঁর পিতার কঠোর নির্দেশনা ছিল। হার্ড টাইমস বইটিতেও দেখানো হয়েছে মিলের মতোই লুইসা পড়াশুনায় এমন একটি কোর্স অনুসরণ করেছে, যেখানে শুকনো(রসবোধহীন ) শিক্ষার ফলে নিজেকে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়ে সে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছিল ।
হার্ড টাইমস বইটিতে দেখানো হয়েছে মিঃ গ্রেডগ্রিন্ড এবং তাঁর মডেল স্কুল, তথ্য ব্যতীত আর কিছুই শেখায় না। পাঠ্যক্রমে কল্পিত / নান্দনিক বিষয়গুলো সম্পূর্ণ অনুপস্থিত । কেবল বিশ্লেষণ, প্রাপ্তব্য ফলাফল এবং গণিতের উপর সেখানে জোর দেওয়া হয়েছে। ফ্যান্সি যে ফ্যাক্টের বিপরীত, তা স্লেয়ারির সার্কাস দ্বারা দেখানো হয়েছে । গ্রেডগ্রিন্ড এবং বাউন্ডার্বি স্লেয়ারিকে বোকা হিসাবে গণ্য করেন। তবে স্লেয়ারি বুঝতে পেরেছিল যে, মানুষকে আনন্দ দেওয়াই হলো তার কাজ । সিসি হলো সার্কাস পারফর্মারের মেয়ে, স্কুলে সে ভালো করতে পারে না; শেখানো অনেক কিছুই সে মনে রাখতে পারে না ; তবে সে সত্যই নির্মলা, পূণ্যবতী ও সততার প্রতীক । গ্রেডগ্রিন্ড এর নিজ ছেলে টম তাঁর লালনপালন রীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শেষে একজন জুয়াড়ি ও চোরে পরিণত হয়। আর তাঁর মেয়ে লুইসা হৃদয়হীনা হিসাবে বেড়ে ওঠে এবং পরে অসুখী বিবাহিতা নারী হিসেবে দিনাতিপাত করে । Bitzer, যে গ্রেডগ্রিন্ড এর শিক্ষা মেনে চলে, সে হয়ে দাঁড়ায় দয়ামায়াহীন আত্মম্ভরী এক ব্যক্তিত্ব ।
নৈতিকতা
ডিকেন্স এই উপন্যাসে ধনী ব্যক্তিকে নৈতিকভাবে দূষিত বলে চিত্রিত করেন। মিঃ বাউন্ডার্বি’র কোনও নৈতিক বিভ্রান্তির জন্য দুঃখবোধ নেই। ব্ল্যাকপুলকে অন্যায়ভাবে তিনি ছাঁটাই করেন, কিন্তু তাতে কোনো তার বিকার নেই। তিনি বাধাহীনভাবে নিজেকে পরিচালনা করেন এবং প্রায়শই হিংস্রতায় কান্ডজ্ঞান হারাতে থাকেন। তিনি তার শৈশব সম্পর্কে চতুরতা -মিথ্যায় পূর্ণ তথ্য প্রদান করতে থাকেন ।
অলস হার্টহাউসের তুলনা করা হয় একটি "আইসবার্গ" এর সাথে, যিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি ধ্বংসাত্মক কারণ হয়ে উঠতে পারেন। কারণ তিনি নিজেই বলেছেন যে তিনি "কোনো নীতিবোধের সহযোগী নন"। নিঃস্ব শ্রমিক স্টিফেন ব্ল্যাকপুল একজন নিখুঁত নীতিবোধসম্পন্ন, প্রতিশ্রুতি মান্যকারী, সদা চিন্তাশীল এবং সহমর্মী ।
হার্ড টাইমস জুড়ে ব্যক্তির নৈতিকতার উপর সামাজিক শ্রেণির প্রভাব নিয়ে ডিকেন্স এর উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেয়েছে। চরিত্রের বিপরীত জুটির মধ্যে স্টিফেন ও রাচেল এবং টম ও মিঃ বাউন্ডার্বি উল্লেখযোগ্য। যেমন স্টিফেনের সততা এবং রাচেলের যত্নশীলতা এমন ক্রিয়াগুলো যা উচ্চ গুণাবলী নির্দেশ করে, অথচ তা টম ও বাউন্ডার্বির মতো উচ্চ শ্রেণীর লোকদের মধ্যে প্রদর্শিত হয় না। সহকর্মীদের নাম বাঁচানোর জন্য স্টিফেন প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে এবং রাচেলও স্টিফেনকে সহযোগিতা / সমর্থন জুগিয়ে যায় সেই লড়াইয়ে। এই আচরণগুলির বিপরীতে দেখা যায় মিঃ বাউন্ডার্বি নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকদের সমস্যাগুলি স্বীকার করতে অস্বীকার করেন , যেমনটি তিনি স্টিফেনের সাহায্যের অনুরোধকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখান করেছিলেন। অন্যান্য কুলীন চরিত্রগুলো স্পষ্টতই অনৈতিক কাজ করে, যেমন টম তার বোনের অর্থ ছুঁড়ে ফেলে, ঋণগ্রস্ত হয়, পরে ব্যাংক ছিনতাইও করে, আর তার দুষ্কর্মের জন্য আবার অন্য কাউকে দায়ী করে। সামগ্রিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানের চরিত্রগুলির মধ্যে নৈতিকতার পার্থক্য দৃশ্যমান। ডিকেন্সের ধারণা হলো নিম্ন ধাপের মানুষদের মধ্যে প্রাকৃতিক আইন অবিকৃতভাবে সংগুপ্ত থাকে। উপযোগবাদের তৈরি মূল্যবোধ দ্বারা টম এবং বাউন্ডার্বি প্রভাবিত হলেও স্টিফেনের মতো ব্যক্তিদের সত্যাসত্য নির্ণয়ের ধারণাকে পথভ্রষ্ট করতে পারে না।
ডিকেন্স এর উপন্যাস অর্থনীতিবিদদের চিন্তাভাবনায় নানা খোরাক দেয়। সেখান থেকে বাজার অর্থনীতির ব্যর্থতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে যায়। শিল্প বিপ্লব তথা GDP এর বৃদ্ধিই যে কেবল মূল বিষয় নয় , ডিকেন্স তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। উপযোগবাদ, ব্যক্তিতাবাদ এসব অর্থনৈতিক দর্শন এর ভিত তিনি নাড়িয়ে দিয়েছেন। ডিকেন্স এর চিন্তায় প্রবৃদ্ধি , দারিদ্র্য, সামাজিক অনাচার-অবিচার - এসবের সমাধান অনেকটা নির্ভর করে ‘সত্যিকার বোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি’র শিক্ষা কার্যক্রম এর ওপর ।
এর আগের পর্বটি দেখার অনুরোধ রইলো -
চার্লস ডিকেন্স-এর অর্থনীতি
[Economics of Charles Dickens]- ১
অলিভার টুইস্ট এর অর্থনীতি (Economics of Oliver Twist )
Comments