অর্থনীতি / অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিবর্তন
(Evolution of Economics/ Economic System)
-প্রফেসর মনতোষ চক্রবর্তী
Email: manotosh.chakravarty@gmail.com
[চলতি অতিমারী COVID-১৯ কি অর্থব্যবস্থার পরিবর্তন / পরিমার্জনের ইঙ্গিত বহন করে? ভবিষ্যৎ এর গর্ভে কি সেই নতুন অর্থনীতির বীজ সংগুপ্ত রয়েছে?]
প্রকৃতির পরই শ্রমের স্থান, আর সকল সম্পদ প্রাপ্তি ও প্রয়োগের মাধ্যম হলো শ্ৰম। প্রকৃতি প্রদত্ত উপাদানকে সম্পদে রূপান্তর করে শ্ৰমই। কাজেই সেই প্রকৃতি (যাকে প্রসারিত অর্থে আমরা ভূমি বলি)-এর পরই হলো শ্রমের স্থান। সমস্ত মানবিক জীবন প্রণালী ও যাবতীয় অর্থব্যবস্থার প্রাথমিক শর্ত বা ভিত্তি হলাে শ্রম, তা ব্যক্তিভিত্তিক বা যৌথ /সম্মিলিত / সমাজভিত্তিক যাই হোক না কেন ।
শ্ৰম হলাে সামাজিক উন্নয়নের মূল ভিত্তি এবং তা একটি অর্থনৈতিক উপাদান। প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে পালা বদলের পরিক্রমায় আধুনিক যুগে যে সামাজিক উত্তরণ ঘটেছে, তা মূলতঃ শ্রমেরই ফসল। আহার্য সংগ্রহ, বন্য পশুর আক্রমন থেকে নিজেকে রক্ষা, খাদ্য মজুত- এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিচ্ছিন্ন মানুষগুলাে একত্রিত হয়েছিল, একত্রিত হয়েছিল প্রতিবেশী গােত্রগুলাে । বিভিন্ন গােত্রভুক্ত মানুষ ‘উপজাতি’ হিসাবে পরিচিত হয়ে সূত্রপাত ঘটায় সম্মিলিত শ্রমের। গােত্রের সদস্যরা গােত্র-প্রধানের নির্দেশে শ্রম প্রদান করতাে। সামাজিক শ্রম বিভাজনের ভিত্তিতে অর্থনীতিতে তখন সূচিত হলাে বিশেষীকরণ। আর তার দ্বারা দু' ধরণের অর্থনৈতিক প্রথা- দেখা দেয়: (১) পশু পালনের অর্থনীতি ও (২) কৃষি অর্থনীতি।
পরবর্তীতে ‘সামাজিক শ্রম বিভাগ’ প্রসারিত হয় বিভিন্ন ধাতু প্রয়ােগের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি নির্মাণ কৌশল ক্ষেত্রে । লৌহ নির্মিত যন্ত্রপাতি, কৃষি অর্থনীতির সম্প্রসারণ ঘটায়। উদ্বৃত্ত উৎপাদন, বিনিময় প্রথাকে জোরদার করে। উৎপাদন বৃদ্ধির সংগে নিয়মতান্ত্রিক বিনিময় যখন যুক্ত হয়, তখন সমাজে উদ্বৃত্ত উৎপাদন এর প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। সেই উদ্বৃত্ত উৎপাদনকে নিজ-ক্ষেত্রে অর্থাৎ আপনজনদের ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টির জন্য গােত্রভুক্ত মানুষগুলাে ক্রমেই বিভিন্ন উপ -গােষ্ঠীতে বিভক্ত হয়। তারপর আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক একক হিসাবে পরিবারের (প্রধানতঃ ‘পিতৃতান্ত্রিক’) উদয় হলাে। শুরু হলাে পবিবারভিত্তিক চাষাবাদ ও পশুপালন।
ব্যক্তিমালিকানা তথা বংশ পরম্পরায় মালিকানা বহাল রাখার প্রথাও জন্ম নিল । আর মালিকানা প্রসার ও বহাল রাখার জন্য সৃষ্টি হলাে সংঘাত। দেখা দিল আধিপত্যবাদ তথা একে অপরকে শােষণ-এর প্রক্রিয়া। জন্ম নিল দাস প্রথা। সামাজিক শ্রম বিভাগের প্রসারণ ও জটিলতা, ধাতব শিল্পের ক্রমােন্নতি, কৃষির প্রসার এসবের জন্য বাড়তি শ্রম শক্তির প্রয়ােজন অনুভূত হয়। ক্রীতদাসকে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করার প্রবণতা দেখা দেয়। দাসেরা পুঁজিপতিদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়। সমাজে তখন দু'ধরনের শ্রেনীর উদ্ভব ঘটে- মালিক ও ক্রীতদাস। অর্থাৎ শুরু হয় -শােষক ও শােষিতের শ্রেনীভেদ।।
জার্মানীতে জমির মালিকানা-স্বত্বের নীতি গৃহীত হয়। তা থেকে সামন্তবাদের সূচনা ঘটে। রােমান ভূস্বামীগণও সামন্ততান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করে। ধনী কৃষকরা সামন্ত প্রভুতে পরিণত হয়। রাজ পরিবার ও ভূস্বামীদের জমি চাষ করতো মুক্ত দাসরা তথা মুক্ত কৃষকরা । তারা ভূস্বামীদের ফসলের অংশ দিত ও তাদের হুকুমমতাে চলতাে। ভারতবর্ষেও দেখা দিল সামন্তবাদের এক ধরনের চেহারা-তা হলাে ‘জমিদারি প্রথা’। জমিদার হলাে ইংরেজ ল্যান্ড-লর্ডেরই একটি অদ্ভুত ধরন, যেখানে খাজনার এক দশমাংশ পেত জমিদার এবং বাকী এক দশমাংশ পেত ইংরেজ সরকার।
এদিকে যুগ অতিক্রমের সাথে সাথে উৎপাদন শক্তির ক্রম প্রসার ঘটতে থাকে। উৎপাদন ক্ষেত্রে নতুন একটি শ্রেনীর উদ্ভব হয়, যারা উৎপাদনে কোন অংশ নেয় না, অথচ উৎপাদন ক্রিয়া তাদের কতৃত্বাধীনে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ পুঁজিপতি শ্রেনীর উদ্ভব ঘটে। উদ্ভব হয় পুঁজিবাদ তথা ধনতন্ত্রের। সামাজিক উপকরণের মালিকানা পুঁজিপতি শ্রেনীর হাতে বর্তায়, এবং নিয়ােগ কর্তা হিসাবে তিনি ভূমিকা পালন করেন। তিনিই বুর্জোয়া হিসাবে মার্ক্স ও এঙ্গেলস কর্তৃক অভিহিত হন। আর তাঁদের মতে, ‘প্রলেতারিয়েত’ হলাে সমাজের সেই মজুরীভিত্তিক শ্রমিকরা , যারা নিজ-শ্রম বিক্রী ছাড়া উৎপাদনের অপর কোন উপকরণের মালিক নয় ।
মধ্যযুগের ভূমিদাসদের মাঝ থেকেই কালের পরিক্রমায় শহরাঞ্চলের স্বাধীন নাগরিকদের উদ্ভব ঘটে। তাদের মধ্যে প্রােথিত হয়ে পড়ে বুর্জোয়া উপাদানের বীজ। উপনিবেশ স্থাপন, নৌ-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, নতুন নতুন আবিষ্কার ইত্যাদি উৎপাদন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তনের সূচনা করে। বৃহৎ থেকে বৃহদাকার হয় উৎপাদন প্রতিষ্ঠান। কার্টেল, ট্রাষ্ট, স্ফীত থেকে স্ফীততর পুঁজি, ক্ষমতার প্রচন্ড দাপট পরিলক্ষিত হতে থাকে । বাজার অর্থনীতির প্রক্রিয়া জোরদার হতে থাকে। তবে বুর্জোয়া-বিকাশের বিপরীত ধারায় প্রলেতারিয়েত-বিকাশও লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানা, বাজার অর্থনীতির পরিবর্তে কোথাও কোথাও নিয়ন্ত্রিত তথা পরিকল্পিত অর্থনীতির প্রবর্তন ঘট, সমাজতন্ত্র এর আগমন ঘটে। সাফল্য ও ব্যর্থতার টানাপােড়নে কখনও তা এগিয়ে গেলেও আবার পিছিয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের অনুশীলন-এর সূত্র ধরে বাজার অর্থনীতির আদর্শ অনুসরণ করে শুরু হয় বিশ্বায়ন ও মুক্ত বাজার ব্যবস্থার পক্ষে মতাদর্শের সম্প্রসারণ ঘটে। তবে বাজার অর্থনীতি ও নিয়ন্ত্রিত(regulated) অর্থনীতির ভাল-মন্দ মিশিয়ে সৃষ্টি হয় যে মিশ্র অর্থনীতি, তাতে আন্তর্জাতিকতাবাদ-জাতীয়তাবাদের সংঘাত , মুক্ত বাণিজ্য ও নিয়ন্ত্রণমূলক বাণিজ্যের পক্ষ-বিপক্ষ, ব্যক্তি উদ্যোগের সাথে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের আপেক্ষিকতার দ্বন্দ্ব এসব আজ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে । মানবজাতির কাছে কোন অর্থ-ব্যবস্থাটি প্রকৃতই গ্রহণযোগ্য, ইতিহাসের ক্রমচলমানতায় অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কেবল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে তো চলছেই । এ পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই, গ্রহন-বর্জনের পালাবদল চলছে, হয়তো চলবে অনন্তকাল ।
ভাবনার বিষয়: চলতি অতিমারী Covid -১৯ কি অর্থব্যবস্থার পরিবর্তনের / পরিমার্জনের ইঙ্গিত বহন করে? ভবিষ্যৎ এর গর্ভে কি নতুন অর্থনীতির বীজ সংগুপ্ত রয়েছে?
পরবর্তী পর্যায়ে এ বিষয়ের ওপর লেখার অভিপ্রায় রয়েছে।
ধন্যবাদ।
-প্রফেসর মনতোষ চক্রবর্তী
Email: manotosh.chakravarty@gmail.com
Комментарии