একটি খাল কিভাবে শিল্প বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করেছে
- প্রফেসর মনতোষ চক্রবর্তী
[ শিল্প বিপ্লবের পশ্চাতে বিশাল অবদান রেখেছিল একটি প্রথম মনুষ্যনির্মিত খাল (ক্যানেল), তার নাম কি ও তার ভূমিকাই বা কি ? ]
ব্রিটেনের ‘দি ব্রিজওয়াটার ক্যানেল’। খালটি 41 মাইল ( 66 কিলোমিটার) দীর্ঘ এবং এর নৌ পরিবহনযোগ্য প্রস্থ (প্রসারতা) সৰ্বোচ্চ 72 ফুট। এ খালের কর্তৃপক্ষ - ‘ম্যানচেস্টার শিপ ক্যানেল কোম্পানি’ ।
এ খাল ইংল্যান্ডের প্রথম মানুষ নির্মিত খাল, যার নামকরণ হয়েছে `ডিউক অফ ব্রিজওয়াটার’ কর্তৃক খনন ও মালিকানা প্রেক্ষিতে।
এ খাল নির্মাণের প্রধান প্রকৌশলী ও কোম্পানির ম্যানেজার ছিলেন জন গিলবার্ট ।
খালটি শুরু হয়েছে উত্তর পশ্চিম ইংল্যান্ডের Worsely থেকে-
তার শেষ সীমানা হলো Runcorn (ম্যানচেস্টার)-
স্টিম ইঞ্জিন চালিত নৌকা বা কার্গো যা ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের অন্যতম কান্ডারি, তারই চলাচল/ প্রয়োগক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল ‘ দি ব্রিজওয়াটার ক্যানেল’।
শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক পর্বটি নৌ-পরিবহন এর উপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিল। ইউরোপে খাল নির্মাণের (খননের) ক্ষেত্রে তখন অবশ্য ফরাসিরা এগিয়ে ছিল। তবে এটি সত্য যে , শিল্পক্ষেত্রে অবদান রক্ষাকারী অর্থাৎ শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার উপযোগী খাল যেটি খনন করা হয়েছিল, সেটি হয়েছিল কিন্তু ব্রিটেনে। ১৭৬১ সনের ১৭ ই জুলাই শিল্প-সহায়ক খননকৃত এ খালটি উন্মুক্ত করা হয়।
ডিউক অফ ব্রিজওয়াটার (আসল নাম হলো Francis Egerton ) উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেই খাল খননের। তিনি ভাবছিলেন- তাঁর মালিনাধীন কয়লা খনিগুলো থেকে বিপুল কয়লা কিভাবে স্বল্প ব্যয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নেয়া যায়। বিশেষ করে ম্যানচেস্টারে তখন অনেক ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছিল এবং সেগুলোতে কয়লার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। তাই উৎসস্থল থেকে অর্থাৎ কয়লাখনি অঞ্চল থেকে কয়লাকে ম্যানচেস্টার -এর বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে যোগান দেয়ার জন্য এ ধরনের খালের প্রয়োজন বিশেষভাবে অনুভূত হয়। ৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেই খাল নির্মাণ করার ফলে শিল্প ক্ষেত্রে কয়লা পরিবহনের ব্যয় নাটকীয় ভাবে হ্রাস পায় । ব্যয় সংকোচন প্রেক্ষিতে বৃহদায়তন উৎপাদন তথা মাত্রাগত উৎপাদন সুবিধা অর্জন( economies of scale) এর প্রেক্ষাপট তৈরী হয়। তাতে শিল্প বিপ্লবের সত্যিকার গতি সঞ্চারিত হয়েছিল।
ডিউক অব ব্রিজওয়াটার খাল খননের জন্য কিভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, এ বিষয়টিও আমরা জেনে নেই। তিনি এক সময় দক্ষিণ ফ্রান্সে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ফ্রান্সের খাল ‘ডিউক ল্যাংগুয়েজ’ পরিদর্শন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন ফ্রান্স 150 মাইল বা 240 কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি আরো জানতে পারেন যে, ভূমধ্যসাগর (মেডিটেরেনেয়ান) এবং আটলান্টিক এর মধ্যে গণপরিবহনের সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্যে সেই খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে ফ্রান্স। এসব দেখে এবং নিজস্ব চিন্তা ভাবনা থেকে ডিউক অব ব্রিজওয়াটার একটি পরিকল্পনার ছক কষে ফেলেন। তার ভিত্তিতে নেয়া হয় খাল খননের উদ্যোগ বৃটেনে। বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণসহ খাল খননের কাজটি দ্রুতই সম্পন্ন হয় । সেই খাল ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে কয়লা আনা-নেওয়া তথা মালপত্র ও কাঁচামাল আনা-নেওয়ার খরচ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল, যা শিল্প সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। কয়লা , লোহা , বস্ত্র শিল্প এবং রেলওয়ে সহ নগরায়িত অর্থনীতির প্রসারে খালের ভূমিকা খুবই গুরুত্ব পেয়েছিল। খাল কাটার প্রয়োজনে প্রযুক্তির যে বিকাশ ঘটেছিলো, তা আবার শিল্প বিপ্লবকেও সহায়তা করে।
লেখক Samuel Smile শিল্প বিপ্লবের একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। তিনি ব্রিজওয়াটার ক্যানালের যে বর্ণনা দেন, তা থেকে জানা যায় - উপত্যকার শীর্ণ খাল এসে পাহাড়ের পাদস্পর্শ করেছে, স্পর্শ করেছে তা বিভিন্ন চ্যানেল হয়ে বিভিন্ন কয়লা খনিকেও। এতে সম্পর্ক-সূত্রও স্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন খনি ও শিল্পের মধ্যে। উত্তোলিত কয়লা নৌকায় করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেওয়া হতে থাকে। যে প্রাকৃতিক জলের ধারার উৎপত্তি হয়েছিল পাহাড়-পাথর ভেদ করে ঝর্ণাকারে , তা থেকে নালা সৃষ্টি হয়েছিল মাত্র এক মাইল লম্বা। সেই নালাই পরে মানুষের দ্বারা হয়েছে বহুগুন লম্বিত। তার অনেকটাই আবার ভূগর্ভস্থ (আন্ডার গ্রাউন্ড) খাল হিসাবে নির্মিত হয়। আন্ডারগ্রাউন্ড (টানেল দিয়ে) দিয়ে যখন কয়লা ভর্তি নৌকাগুলো এগোতে থাকে, অপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারণা তখন হয়। সারি সারি নৌকা কয়লা বোঝাই হয়ে চলাচলের মাধ্যমে যে নৌ পথের সৃষ্টি করেছে, তার দ্বারা কোলিয়ারিগুলো যেমন জীবন্ত হয়ে উঠে, তেমনি বাড়তি কয়লা সরবরাহ করে কর্মরত মানুষগুলোর কাজের স্পৃহাকেও বাঁচিয়ে রাখে এ খাল। এ খালের মাধ্যমে যেহেতু কয়লা, বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে সহজে ছড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে, ফলে শিল্প বিপ্লব হতেও দেরি হয়নি। কারণ শিল্প বিকাশের পশ্চাতে প্রয়োজনীয় শক্তি /জ্বালানী যোগান দিয়েছে এ খাল। কয়লা ব্যবহৃত হয় কয়লা উত্তোলনেও, সেখানে খনিতে জমে থাকা জল নিষ্কাশনে স্টিম ইঞ্জিন প্রয়োগ, শক্তি চালিত নৌকা/ জাহাজ চলাচলে কয়লার প্রয়োগ, বস্ত্র শিল্পে যন্ত্র চালিত তাঁত , রেলওয়ে লোকোমোটিভ এর ক্ষেত্রে কয়লা তথা স্টিমের ব্যাপক ব্যবহারের সুযোগ ঘটে। আর সেখানে ‘ দি ব্রিজওয়াটার ক্যানেল’ নীরবে বহমান থেকে শিল্প বিপ্লবের ধারাকে অব্যাহত রাখতে সহায়তা করেছে। তাই শিল্প বিপ্লবের সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছে ব্রিটেনের প্রথম মনুষ্যনির্মিত খাল ‘ দি ব্রিজওয়াটার ক্যানেল’। এই খাল নির্মিত হয়েছিল বলেই ব্রিটেন শিল্প বিপ্লবের কর্ণধার হতে পেরেছিলো, আর সারা পৃথিবী সেই শিল্প বিপ্লবের সুফল পেয়েছে। তাই শিল্প বিপ্লবের অন্যতম বাহন ‘ দি ব্রিজওয়াটার ক্যানেল’ এর কথা মানুষ এখনো কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে। ছোট্ট ঝর্ণাধারা সৃষ্ট নালা কে ক্যানালে পরিণত করে শিল্প বিপ্লবের নৌকা বাওয়ার যে সুযোগ ঘটেছিলো, তা থেকে মানুষ বুঝতে পারে - প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত আপাত ক্ষুদ্র জ্ঞানকে নালায় আটকে না রেখে খাল খননের মতো বাধা মুক্ত করে দিতে হবে, যাতে জ্ঞান বিপ্লবের নৌকা তর তর করে বাইতে পারে।
ধন্যবাদ সবাইকে।
তথ্যসূত্র ও ফটোগ্রাফের জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
Wikipedia ও বিভিন্ন ফটো মাধ্যম।
Smiles, Samuel (2006), Lives of the Engineers
ধন্যবাদ অন্তে - প্রফেসর মনতোষ চক্রবর্তী
ความคิดเห็น