অর্থনৈতিক দক্ষতা(Economic efficiency) বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝানো হয় যেখানে বিবেচ্য প্রত্যেকটি সম্পদ কাম্য ভাবে ব্যবহৃত হয়, যার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তি বা বিবেচ্য সংগঠন এর অদক্ষতা ও অপব্যয়/ অপচয় হবে ন্যূনতম। অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক দক্ষতা বলতে সাধারণভাবে এমন একটি অবস্থাকে বলা হয়, যেখানে অপর কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে একজনের উপকার করা যায় না অথবা কোন অবস্থার ক্ষতি না করে অপর কোন অবস্থার উন্নতি সাধন করা যায় না। এই অবস্থাকে প্যারেটো দক্ষতা(কাম্যতা) বলা হয় ।
ব্যক্তির কাজের দ্বারা অর্থনৈতিক দক্ষতা অর্জিত হলে সামগ্রিকভাবেও সমাজের অর্থনৈতিক দক্ষতা অর্জিত হয়। ব্যক্তি তার নিজের স্বার্থে দক্ষতা বৃদ্ধির প্রয়াস চালাতে থাকে এবং এভাবে যদি সবাই অর্থনৈতিক দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট থাকে, তবে দেশের সম্পদ/ ব্যয় প্রেক্ষিতে সমাজের নিট উপকার প্রাপ্তিও বাড়তে থাকবে। অর্থনৈতিক কাজের দ্বারা সমাজের উপকার বা কল্যাণ সর্বোচ্চকরণ এর সাথে সমাজের অর্থনৈতিক দক্ষতা সঙ্গতিপূর্ণ হবে।
অর্থনীতিতে অর্থনৈতিক দক্ষতা অর্থাৎ ইকোনমিক এফিশিয়েন্সি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিতে আমরা যখন দক্ষতা বিচারের কথা বলি, তখন বাজার কার্যক্রমের দক্ষতা অর্থাৎ বাজার অর্থনীতির দক্ষতা আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। এর সূত্র ধরে আসে গণতান্ত্রিক কার্যক্রম তথা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দক্ষতা বিচারের প্রসঙ্গ। অর্থনীতি বিষয়ে কল্যাণ অর্জনের লক্ষ্য প্রায়শই উচ্চারিত হয়। সমাজের কল্যাণ সর্বোচ্চকরণে অর্থনৈতিক দক্ষতা ধারণার প্রয়োগ সুবিদিত। পরিবেশ সমুন্নত রাখতে অর্থনৈতিক দক্ষতা ধারণাকে প্রয়োগ করা হয়, তবে বাজার অর্থনীতির ব্যর্থতার কথা সেখানে স্বীকার করে নেয়া হয়। ব্যষ্টিক অর্থনীতি, সামষ্টিক অর্থনীতি, সরকারি অর্থব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, পরিবেশ অর্থনীতি এভাবে অর্থনীতির সর্বত্রই অর্থনৈতিক দক্ষতা (ইকনোমিক এফিশিয়েন্সি) ধারণা বিশেষ গুরুত্ব পায়।
মানুষের প্রত্যেক কাজের অর্থনৈতিক প্রতিদান/ ফলাফল(economic outcome) আছে, তা ধনাত্মক বা ঋণাত্মক যে কোনটি হতে পারে। কোন কাজের অর্থনৈতিক প্রতিদান/ ফলাফল(economic outcome) এর কাম্যতা(desirability) যাচাই করতে হলে ইকোনমিক ইফিসিয়েন্সির স্ট্যান্ডার্ড(মানদণ্ড) প্রয়োগ করতে হবে।
যে কোন কাজের লক্ষ্য হলো সেই কাজ থেকে উপকার পাওয়া। আর কাজটি সম্পন্ন করতে গিয়ে সময় দিতে হচ্ছে, দিতে হচ্ছে এনার্জি(শারীরিক ও মানসিক শক্তি সম্পদ) এবং রিসোর্সেস (সম্পদ)। কাজেই এসব যখন ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন এসে পড়ছে খরচ প্রসঙ্গ। প্রত্যেক কাজের এক পিঠে উপকার, আরেক পিঠে আছে ব্যয়। কোনো কাজ করতে গিয়ে যদি দেখা যায় উপকারের চাইতে বেশি ব্যয় হয়ে যাচ্ছে, তবে সেই কাজ কাম্য হতে পারে না। তা হতে পারে ইনেফিসিয়েন্টলি ওভার একটিভিটি। আর যে কাজের প্রতিদান হিসাবে প্রাপ্তব্য উপকার, কাজ সংশ্লিষ্ট ব্যয়-এর চেয়ে বেশি, অথচ সর্বোচ্চ নিট উপকার তখনও হয়তো অর্জিত হয়নি, এমতাবস্থায় যদি কাজ থামিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা হবে কাম্য একটিভিটি এর তুলনায় নিম্ন একটিভিটি ( যাকে বলা যায় ইনেফিসিয়েন্টলি লোয়ার একটিভিটি)। কাজ-এর স্তরকে সেই সীমা পর্যন্ত এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন, যেখানে উপলব্ধি করা যাবে যে, সর্বোচ্চ নিট উপকার স্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে , আর সেখানে প্রান্তিক উপকার ও প্রান্তিক ব্যয় হয়েছে সমান এবং এরপর কাজের স্তরকে আরও এগিয়ে নেয়া হলে উপকার প্রাপ্তির চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে পড়বে। কাজেই এই সর্বোচ্চ নিট উপকার প্রাপ্তি নির্দেশকারী অবস্থিতি হলো অর্থনৈতিকভাবে দক্ষ (বা কাম্য) কাজের পরিমাণ। এভাবে খরচ এবং উপকার এই দুয়ের আপেক্ষিকতার ভিত্তিতে আমরা বিচার করতে পারি , বিবেচ্য কাজটি অর্থনৈতিকভাবে দক্ষ কি দক্ষ নয়।
বিবেচ্য কাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে সম্ভাব্য নিম্নতম ব্যয়ে নির্দিষ্ট উপকার প্রাপ্তি অথবা প্রাপ্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থেকে সর্বোচ্চ ভ্যালু (মান ) প্রাপ্তি অর্থনৈতিক দক্ষতা বা ইকোনমিক ইফিসিয়েন্সি নির্দেশ করে।
চিত্রে অর্থনৈতিক দক্ষতার বিষয়টি নির্দেশ করা হলো। দুটি অক্ষ টানা হয়েছে। লম্ব অক্ষে প্রান্তিক ব্যয় ও প্রান্তিক উপকার পরিমাপ করা হয় এবং ভূমি অক্ষে অর্থনৈতিক কাজ তথা অর্থনৈতিক কাজের মাধ্যমে দ্রব্য ও সেবার পরিমাণ নির্দেশিত হয়েছে। MB রেখা ডানদিকে নিম্নগামী, যা প্রান্তিক উপকার নির্দেশক রেখা। কাজের পরিমাণ যত বাড়বে এবং সংশ্লিষ্ট দ্রব্য ও সেবার পরিমাণ যত বাড়তে থাকবে, তা থেকে প্রাপ্তব্য প্রান্তিক উপযোগ বা প্রান্তিক উপকার ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে। তাই প্রান্তিক উপকার রেখা ডানদিকে নিম্নগামী। প্রান্তিক ব্যয়(MC) রেখার দ্বারা বিবেচ্য কাজের সুযোগ ব্যয় সহ অতিরিক্ত ব্যয় তথা প্রান্তিক ব্যয় প্রকাশ পায়। অর্থনৈতিক কাজ যত বাড়তে থাকবে, প্রান্তিক ব্যয়ও বাড়তে থাকবে। আর সে কারণে প্রান্তিক ব্যয় রেখা উপরের দিকে উঠবে। প্রান্তিক উপযোগ ও প্রান্তিক ব্যয় রেখা যেখানে ছেদ করে তা e বিন্দু দ্বারা নির্দেশ করা হল। সেখানে লক্ষ্য করা যায় যে, প্রান্তিক উপকার এবং প্রান্তিক ব্যয় পরস্পর সমান। আর সেখানে যে অর্থনৈতিক কাজ নির্দিষ্ট হয়েছে তা OA2। সেটি কাম্য বা অর্থনৈতিকভাবে দক্ষ কাজ তথা দ্রব্য বা সেবার পরিমাণ।
OA2 অ্যাক্টিভিটি লেভেলের কম OA1 অ্যাক্টিভিটির ক্ষেত্রে প্রাপ্ত প্রান্তিক উপকারের পরিমাণ প্রান্তিক ব্যয় অপেক্ষা বেশি। তাহলে OA1 থেকে অগ্রসর হলে প্রান্তিক ব্যয়ের চেয়ে প্রান্তিক উপকার তখনও বেশি হতে দেখা যায়। তাহলে অ্যাক্টিভিটি OA1 থেকে OA2 এর দিকে এগিয়ে গেলে নিট উপকার প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেখানে যদি কেউ অগ্রসর না হয় , তবে প্রাপ্তব্য নিট উপকার থেকে বঞ্চিত হতে হলো। কাজেই অ্যাক্টিভিটি OA1 কে এফিসিয়েন্ট বলা যাবে না, তা হলো ইনএফিসিয়েন্ট। আবার OA2 কে ছাড়িয়ে অ্যাক্টিভিটি OA3 হলে প্রান্তিক ব্যয়ের পরিমাণ, প্রান্তিক উপকারের চাইতে বেশি । কাজেই OA3 কাজ করা অর্থহীন। কারণ সেখানে অতিরিক্ত কাজ থেকে প্রান্তিক উপকার যা পাওয়া যাচ্ছে, তা প্রান্তিক ব্যয় থেকে কম। আমি কাজ করবো বেশি, সময়, শক্তি ও সম্পদ বেশি করে খরচ করবো অথচ উপকার পাবো কম। এটি কাম্য হতে পারে না। তাই OA3 ইনএফিশিয়েন্সি নির্দেশ করছে। কাজেই OA2 এর তুলনায় কম (যেমন OA1 হলো too little activity level) এবং OA2 এর তুলনায় বেশি (যেমন OA3 হলো too much activity level) -কোনো এক্টিভিটি কাম্য হতে পারে না। সুতরাং A1 ও A3 ইনেফিসিয়েন্ট এবং কেবল A2 হলো এফিসিয়েন্ট অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে দক্ষ বা কাম্য এক্টিভিটি লেভেল ।
ধন্যবাদ।
Comments