শিল্প বিপ্লব ও শিশু-শ্রম
(The Industrial Revolution and the child labour)
[শিল্প বিপ্লবে শিশুদের ভূমিকা/ ত্যাগ স্বীকার]
[ ফ্যাক্টরি- লাইফ এবং শিল্প বিপ্লব]
- মনতোষ চক্রবর্তী
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ফ্যাক্টরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকরা বহু কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ চালিয়ে যেত। সে সময় ব্রিটেনে দ্রুতগতিতে ফ্যাক্টরির সংখ্যা বাড়ছিল, কিন্তু ফ্যাক্টরি পরিচালনার জন্য যে ধরনের নিয়ম নীতি থাকা প্রয়োজন তা তখনও প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। কাজেই যেসব শ্রমিক ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো , তাদের জন্য কাজের কোনো নীতি নিয়ম মেনে চলা হতো না। দীর্ঘ সময় (বহু ঘন্টা) ধরে তাদেরকে কাজ করতে হতো, নানা বিপদজনক /অনিরাপদ মেশিনকে সাথে নিয়ে। শ্রমিকরা সেখানে খুব কম সময়ের জন্যেই বিশ্রাম পেত। ছোট ছোট শিশুরা পর্যন্ত সেখানে কাজ করতে বাধ্য হতো। যেহেতু শারীরিকভাবে বড় দেহধারীরা কোনো কোনো কাজের জন্য উপযুক্ত নয়।, সে অবস্থায় ছোটদের প্রয়োজন পড়তো- এমনকি ৪/৫ বছর বয়সীদেরকেও কাজে টেনে আনা হতো, যাতে তারা হামাগুড়ি দিয়ে মেশিনের নিচের অংশে গিয়ে কেটে যাওয়া সুতাকে আবার জোড়া বেঁধে দিয়ে আসতে পারে অথবা মেশিন সাফ করতে পারে অথবা বা ছোট ছোট মেরামতের কাজ করতে পারে । এছাড়াও সুউচ্চ চিমনিগুলোকে পরিষ্কারের জন্য শিশু শ্রমিক প্রয়োজন পড়তো । শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে ছোট ছোট শিশুদের সেই যে হামাগুড়ি ও চিমনে বেয়ে ওপরে ওঠার ভূমিকা, তা একালের অনেক মানুষের জন্যই বিস্ময়ের! মানুষ আজ স্মরণ করে কিভাবে ছোট ছোট শিশুরা তাদের শ্রম দিয়ে, কতটা ঝুঁকি নিয়ে শিল্প বিপ্লবের ভিত্তি রচনা করেছিল!
শিল্প বিপ্লবের যুগে শ্রমের মূল্যবান উৎস হিসাবে শিশুদেরকে তখন বিবেচনা করা হতো। বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে এমনকি কয়লা খনিতেও শিশু শ্রমিক নিয়োজিত হতো। ফ্যাক্টরির মালিকরা লক্ষ্য করেছিলেন - শিশুদেরকে তুলনামূলকভাবে সহজে শৃঙ্খলা পরায়ন করে তোলা যায়। এ ছাড়াও তাদেরকে সস্তায় নিয়োগ দেয়া যায়, যা ফ্যাক্টরি মালিকের জন্য লাভজনক। কিন্তু ফ্যাক্টরির অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে শিশু শ্রমিকরা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তো , কেউ আহত হতো , কেউ প্রাণ হারাতো। দরিদ্র পিতৃ মাতৃহীন শিশুরা প্রধানত ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে বাধ্য হতো।
একটি স্কটিশ ফ্যাক্টরিতে কিভাবে এক শিশু শ্রমিক তার দৈনন্দিন জীবন যাপন করতো , তার একটি বর্ণনা পাওয়া যায় জেমস মিলের লেখনীতে। সেই শিশু শ্রমিকের অবস্থাকে ক্যারোলিনার ক্রীতদাসদের জীবনের সাথে তুলনা করা যায় । ১৮২৭ সালের প্রেক্ষাপটে প্রদত্ত সেই বর্ণনা আজও আমাদের জন্যে মর্মস্পর্শী :
“যখন আমি একটি স্পিনিং মিলে প্রবেশ করি, তখন আমার বয়স ছিল সাত । প্রতিদিন ভোর পাঁচটার সময় আমাকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হতো , কারণ সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আমাকে কাজে যোগ দিতেই হবে । মাঝখানে প্রাতঃরাশ (ব্রেকফাস্ট)এর সময় ছিল সকাল ন’টা। কাজ আবার শুরু হতো সাড়ে ন’টার সময় এবং একটানা চলতো দুপুর দুটো পর্যন্ত। দুপুর দুটোর পরে শুরু হতো লাঞ্চ । দুপুর আড়াইটার সময় কাজ আবার শুরু হতো এবং রাত সাড়ে সাতটা পর্যন্ত একটানা কাজ চলতো । এটাই ছিল প্রতিদিনের কাজ, প্রতিদিনের রুটিন। কিন্তু বাস্তবতা হলো ঘন্টা বাঁধা কাজ কিন্তু নিয়মিত ছিল না। মিলের মালিক বা ম্যানেজার যা মনে করতেন, যা খুশি তার মনে আসতো সে অনুযায়ী আমাদের আরো দীর্ঘ সময় কাজ করতে হতো। ফ্যাক্টরির ঘড়িগুলোতে ইচ্ছে করে ‘কাটা’ ঘুরিয়ে রাখা হতো, যাতে অনেক রাত অব্দি শ্রমিকদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেয়া যায়। সময়ের এই যে লুকোচুরি/ জালিয়াতি এবং অ-সততা, আর সেই সাথে বঞ্চনা ও শোষণের কর্ম পরিবেশ- এর মধ্যে আমাদের কাজ করতে হতো। আমার এ ছোটবেলার নিত্যদিনের কাহিনী তো ক্যারোলিনার ক্রীতদাসের জীবনের চেয়ে কম মর্মান্তিক নয়!”
তবে ইউরোপীয় সমাজ কিছুকালের মধ্যে উপলব্ধি করেছিল - যে বয়সে শিশুরা খেলাধুলা বা আনন্দ-উৎসব করবে সেই শিশুদেরকে নিরানন্দ পরিবেশে কাজের মধ্যে ঠেলে দেওয়া তথা মৃত্যু -ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া কিছুতেই কাম্য হতে পারে না । সুশীল সমাজের চাপে আইন করে শিশু শ্রমিকদের কাজে নিযুক্তি নিষিদ্ধ করা হয়। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ সরকার ফ্যাক্টরি নীতিমালা(Factory Act )এর সূচনা করেন, যাতে শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নত হয়।১৮৩০ এবং ১৮৪০ এর দশকে নতুন নতুন আইন দ্বারা অতি অল্প বয়সের শিশুদের ফ্যাক্টরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। আর যেসব বালক/ বালিকা কিছুটা বড় হয়েছে, তাদের কাজের সীমিত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ১৮৬০ এবং ১৮৭০ দশকের মধ্যে শিশু শ্রমের আরো যে বিভিন্ন ধরণ আছে, যেমন চিমনি পরিষ্কার এর জন্য উপরে শিশুকে পাঠানো, তা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ , সেই ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয় ।
‘শিল্প বিপ্লব ও শিশু শ্রম’ থেকে উদ্ভুত শিল্প বিপ্লবের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের জন্য কি শিক্ষণীয়?
শিল্প বিপ্লবের সফলতার পশ্চাতে কিভাবে শিশু শ্রমিক তাদের শ্রম/ জীবন দিয়ে গেছে, ক্রীতদাসরা বংশ পরম্পরায় কিভাবে তাদের রক্ত ও ঘাম ঝরিয়েছে, তাকে স্মরণে রাখতে হবে বৈকি! হতভাগ্য ক্রীতদাস বা দুর্ভাগা শিশু শ্রমিকের উপর নির্দয়ভাবে যে অত্যাচার চলত, তা শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগকারীরা কি মনে রেখেছে ?
মানব সভ্যতার ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা শতাব্দি ধরে সারা বিশ্বে বিভিন্ন জাতি ও রাষ্ট্রের উপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লব অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রথমে শুরু হলেও সম্পূর্ণ শতাব্দি ধরে তার প্রভাব থেকে যায় এবং শিল্প বিপ্লবের ফলাফল আমরা বর্তমান শতাব্দিতেও বহন করে চলেছি। সমাজের উপর শিল্প বিপ্লব যেমন ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তেমনি তার নেতিবাচক প্রভাব অনস্বীকার্য।
উৎপাদন ক্ষেত্রে যন্ত্রকৌশল উদ্ভাবন ও তার প্রয়োগ বহু ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু শিল্প বিপ্লবের নেতিবাচক উপাদানগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। যেমন অন্যতম নেতিবাচক দিকটি ছিল কাজের নোংরা পরিবেশে দুর্বিষহ জীবনের গ্লানি মেনে নিয়ে অতি কম মজুরিতে শিশুশ্রম নিয়োগ।
শিল্প বিপ্লব উদ্ভবের কারণ হিসাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিতাবাদ / বিশুদ্ধ পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের বিকাশকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে সাধারণতঃ বিবেচনা করা হয়। ব্যক্তিতাবাদ / বিশুদ্ধ পুঁজিবাদ হল একটি সর্বোচ্চ ব্যক্তিকেন্দ্রিক আদর্শবাদ, যেখানে সরকার দেশের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ন্যূনতম ভূমিকা পালন করে। ইতিহাসবিদরা অবশ্য এই ব্যক্তিতাবাদ আদর্শকে অর্থাৎ শিল্প বিপ্লবের চরিত্রকে 'ক্লাসিকাল উদারতাবাদ' হিসাবে গণ্য করেন, যাকে ‘ক্লাসিক্যাল লিবারেলিজম’ বলা হয়। যেহেতু এই ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক ব্যক্তিগত অধিকারগুলো অনুমোদিত হয়, তাই সেই সুযোগে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এমনভাবে পরিচালিত হয়, যাতে ফ্যাক্টরি মালিকরা দরিদ্র শ্রমজীবীদের শোষণ করতে সমর্থ হয়, দুর্বিষহ কর্মপরিবেশে অতি অল্প বয়সে শিশুরাও পর্যন্ত শ্রম দিতে বাধ্য হয়, যেখানে কাজের পরিবেশ নোংরা ও বিপদসংকুল এবং সেখানে সরকারের পর্যাপ্ত নিরাপত্তাও অবহেলিত। কাজেই অর্থনীতির শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে ‘সর্বোচ্চ ব্যক্তিকেন্দ্রিক আদর্শবাদ’ একটি অর্থনীতির জন্য সর্বোচ্চ কাম্য নাও হতে পারে ।
- মনতোষ চক্রবর্তী
Comments